নিউট্রন তারা কীভাবে তৈরি হয়?
নিউট্রন তারা হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঘন ও আকর্ষণীয় বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। এগুলো বিশাল নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে সৃষ্ট হয়। নিচে নিউট্রন তারার গঠন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
১. নিউট্রন তারার গঠন প্রক্রিয়া
নিউট্রন তারা সাধারণত একটি বিশাল নক্ষত্রের (৮ থেকে ২০ সৌর ভরের) সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে বিভক্ত:
ক. নক্ষত্রের জীবনচক্রের শুরু
• বিশাল নক্ষত্রের গঠন: নিউট্রন তারা শুধুমাত্র বিশাল নক্ষত্র থেকে তৈরি হয়, যাদের ভর সূর্যের তুলনায় ৮ থেকে ২০ গুণ বেশি। এই নক্ষত্রগুলো তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় হাইড্রোজেন ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে, যার ফলে হিলিয়াম তৈরি হয়।
• ক্রমান্বয়ে ভারী মৌলের ফিউশন: হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে নক্ষত্রটি হিলিয়াম ফিউশন শুরু করে, যা কার্বন ও অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ভারী মৌল (নিয়ন, ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন) তৈরি হয়। সবশেষে, নক্ষত্রের কেন্দ্রে লোহার (Iron) কোর তৈরি হয়।
খ. লোহার কোরের সীমাবদ্ধতা
• ফিউশনের সীমা: লোহার কোরে আর ফিউশন সম্ভব হয় না, কারণ লোহার ফিউশন শক্তি উৎপন্ন করার পরিবর্তে শক্তি শোষণ করে। ফলে, কোরে আর বাইরের দিকে চাপ সৃষ্টি হয় না।
• মাধ্যাকর্ষণ ধস: যখন লোহার কোরের ভর চন্দ্রশেখর সীমা (প্রায় ১.৪ সৌর ভর) অতিক্রম করে, তখন নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশ মাধ্যাকর্ষণের কারণে দ্রুত ধসে পড়ে। এই ধসে পড়া প্রক্রিয়া মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডে ঘটে।
গ. সুপারনোভা বিস্ফোরণ
• প্রোটন-ইলেকট্রন সংমিশ্রণ: কোর ধসে পড়ার সময় অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বের কারণে প্রোটন ও ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে নিউট্রন ও নিউট্রিনো তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়।
• শকওয়েভ: ধসে পড়া কোর থেকে উৎপন্ন শক্তি বাইরের স্তরগুলোকে বিস্ফোরিত করে, যা সুপারনোভা হিসেবে পরিচিত। এই বিস্ফোরণে নক্ষত্রের বাইরের স্তরগুলো মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে।
• অবশিষ্ট কোর: সুপারনোভার পর কোরের অবশিষ্টাংশ অত্যন্ত ঘন হয়ে নিউট্রন তারায় রূপান্তরিত হয়।
২. নিউট্রন তারার বৈশিষ্ট্য
• ঘনত্ব: নিউট্রন তারার ঘনত্ব এত বেশি যে, এক চা চামচ নিউট্রন তারার উপাদানের ভর হতে পারে কয়েক বিলিয়ন টন। এর কারণ হলো প্রায় পুরো বস্তুটি নিউট্রন দিয়ে গঠিত।
• আকার: এদের ব্যাস সাধারণত ১০-২০ কিলোমিটার, অর্থাৎ একটি শহরের আকারের সমান।
• চৌম্বক ক্ষেত্র ও ঘূর্ণন: নিউট্রন তারার চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। অনেক নিউট্রন তারা দ্রুত ঘুরে, যার ফলে কিছু কিছু পালসার হিসেবে পরিচিত। এরা নিয়মিত বিরতিতে রেডিও তরঙ্গ নির্গত করে।
• গঠন: নিউট্রন তারার গঠন স্তরবিশিষ্ট। বাইরের স্তরে ক্রাস্ট থাকে, যা নিউট্রন ও ভারী নিউক্লিয়াস দিয়ে তৈরি। কেন্দ্রে সম্ভবত সুপারফ্লুইড নিউট্রন বা কোয়ার্ক ম্যাটার থাকতে পারে।
৩. নিউট্রন তারার প্রকারভেদ
• পালসার: দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারা, যারা নিয়মিত রেডিও তরঙ্গ নির্গত করে।
• ম্যাগনেটার: অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রযুক্ত নিউট্রন তারা, যারা গামা রশ্মি নির্গত করতে পারে।
• এক্স-রে নিউট্রন তারা: এরা সঙ্গী নক্ষত্র থেকে পদার্থ শোষণ করে এক্স-রে বিকিরণ নির্গত করে।
৪. নিউট্রন তারার গঠনে প্রভাবক ফ্যাক্টর
• নক্ষত্রের প্রাথমিক ভর: নিউট্রন তারা গঠনের জন্য নক্ষত্রের ভর ৮ থেকে ২০ সৌর ভরের মধ্যে হতে হবে। এর চেয়ে কম ভর হলে শ্বেত বামন (White Dwarf) তৈরি হয়, আর বেশি ভর হলে কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) তৈরি হয়।
• মাধ্যাকর্ষণ ও কোয়ান্টাম চাপ: নিউট্রন তারার কাঠামো নিউট্রন ডিজেনারেসি চাপ (Neutron Degeneracy Pressure) দ্বারা সমর্থিত হয়, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পলি নিষেধ নীতির ফল।
• নিউট্রিনোর ভূমিকা: সুপারনোভার সময় নির্গত নিউট্রিনো শক্তি স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. নিউট্রন তারার গবেষণা ও গুরুত্ব
• মহাকর্ষ তরঙ্গ: নিউট্রন তারার সংঘর্ষ মহাকর্ষ তরঙ্গ উৎপন্ন করে, যা LIGO-এর মতো যন্ত্র দিয়ে শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষ থেকে মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রথম শনাক্ত হয়।
• মৌলের উৎপত্তি: সুপারনোভা ও নিউট্রন তারার সংঘর্ষের মাধ্যমে সোনা, রুপা ইত্যাদি ভারী মৌল তৈরি হয়।
• ফিজিক্সের পরীক্ষাগার: নিউট্রন তারার অত্যন্ত ঘন পরিবেশ পদার্থের আচরণ ও কোয়ান্টাম ফিজিক্স অধ্যয়নের জন্য আদর্শ।
৬. উদাহরণ ও পর্যবেক্ষণ
• প্রথম পালসার: ১৯৬৭ সালে জোসেলিন বেল বার্নেল প্রথম পালসার আবিষ্কার করেন, যা পরে নিউট্রন তারা বলে নিশ্চিত হয়।
• ক্র্যাব নেবুলা: এই নেবুলার কেন্দ্রে একটি পালসার রয়েছে, যা ১০৫৪ সালের সুপারনোভার ফল।
৭. চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ গবেষণা
• অভ্যন্তরীণ গঠন: নিউট্রন তারার কেন্দ্রে কী আছে (নিউট্রন সুপারফ্লুইড, কোয়ার্ক ম্যাটার, বা অন্য কিছু) তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
• মহাকর্ষ তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ: ভবিষ্যতে আরও নিউট্রন তারার সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ মহাবিশ্বের বিবর্তন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
• চৌম্বক ক্ষেত্রের রহস্য: ম্যাগনেটারের শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
নিউট্রন তারা হলো বিশাল নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষ পরিণতির একটি রূপ, যা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তৈরি হয়। এদের অত্যন্ত ঘন গঠন, শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র, এবং দ্রুত ঘূর্ণন মহাবিশ্বের চরম পদার্থ ও শক্তির আচরণ বোঝার জন্য একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউট্রন তারা গবেষণা মহাকর্ষ তরঙ্গ, ভারী মৌলের উৎপত্তি, এবং মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
গানিতিক বিশ্লেষণ
নিউট্রন তারার গঠন ও বৈশিষ্ট্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ জটিল এবং এটি মাধ্যাকর্ষণ, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, এবং পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের সংমিশ্রণের ওপর নির্ভর করে। নিচে নিউট্রন তারার গঠন প্রক্রিয়া ও এর বৈশিষ্ট্যের গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ দেওয়া হলো। এই বিশ্লেষণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ ও ধারণা তুলে ধরা হবে, যা নিউট্রন তারার গঠন ও আচরণ বোঝাতে সাহায্য করে।
১. নিউট্রন তারার গঠন: গাণিতিক পটভূমি
ক. চন্দ্রশেখর সীমা (Chandrasekhar Limit)
নিউট্রন তারার গঠনের জন্য নক্ষত্রের কোরের ভর একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে হয়, যা চন্দ্রশেখর সীমা নামে পরিচিত। এই সীমা নির্ধারণ করে কখন ইলেকট্রন ডিজেনারেসি চাপ মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কোরকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়।
👍
উত্তরমুছুন