জ্যোতির্বিজ্ঞান - B@K@R_PHYSICS

মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০১৪

জ্যোতির্বিজ্ঞান

আজকের লেকচারের আলোচ্য বিষয় প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা। প্রাচীনকালে যেহেতু বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি সেহেতু জ্যোতির্বিজ্ঞান না বলে জ্যোতির্বিদ্যা বলছি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা যত পুরনো জ্যোতির্বিদ্যাও ততো পুরনো। তবে আমরা শুরু করব ব্যাবিলনীয় সভ্যতা দিয়ে, কারণ তখনকার জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও জানি।

মানুষ তখন সবে কৃষিকাজ শিখেছে, আর কৃষির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঋতু পরিবর্তনের, যে ঋতু নিয়ন্ত্রিত হয় সূর্যের মাধ্যমে। ঋতুর সাথে আবার আকাশের অনেক তারার অবস্থান মিলে যায়। তাই আকাশ জানাটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তারা দেখতো প্রতি ভোরে সূর্য পূর্বে উদিত হয় এবং সন্ধ্যায় পশ্চিমে অস্ত যায়, আবার প্রতি সন্ধ্যার পরপর চাঁদ এবং তারারা সেই একই পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং ভোরের আগে আগে পশ্চিমে অস্ত যায়। কখনোই এর ব্যতিক্রম হয়না। এক রাতে হঠাৎ আকাশের কোন এক কোণায় নতুন কোন তারামণ্ডলের উদয় হয় না। এ কারণে আকাশ প্রাচীনদের কাছে একটা নির্ভরতা প্রতীক ছিল। তারা ভাবতো এই আকাশই স্বর্গ কারণ সেখানে কোন অনিয়ম নেই। স্বর্গের অদ্ভুত বস্তুগুলোকে তারা দেবতা বানিয়েছিল। ব্যাবিলনীয়রা সেই অতিপ্রাকৃত জ্যোতির্বিদ্যা বা জ্যোতিষ শাস্ত্রেরই ধারক ও বাহক ছিল। তারা মনে করতো জ্যোতিষ্কগুলোর সাথে আমাদের নিয়তি গভীরভাবে সম্পর্কিত।
এখানে ব্যাবিলনীয় সম্রাজ্যের একটা মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। আনুমানিক ২০০০ খপ থেকে ৫০০ খপ পর্যন্ত এই সম্রাজ্য প্রভাবশালী ছিল। তারা মহাবিশ্বের একটা মডেল বানিয়েছিল তাদের বিশ্বাস অনুসারে। এই ছবিটার মাধ্যমে তাদের মডেল দেখানো হয়েছে। মাঝখানের এই ধাপধাপ পাহাড়ের মত জায়গাটা হচ্ছে পৃথিবী। পৃথিবীর চারদিকে একটা সমুদ্রের বলয় আছে। সমুদ্রের বলয় ঘিরে আছে পাহাড়ের বলয়, যে পাহাড়গুলো স্বর্গকে ধরে রাখে, যাতে তা পৃথিবীর উপর পড়ে না যায়। পৃথিবীর উপরে তারা তিনটা স্বর্গ কল্পনা করতো। স্বর্গগুলোর বাইরে ছিল স্বর্গীয় সমুদ্র। আর পৃথিবীর নিচে নরক। নরক আবার সাতটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।
তাদের মহাজাগতিক মডেল যতোই কিম্ভুতকিমাকার হোক না কেন, জ্যোতিষ্কের গতিবিধি তারা খুব ভালই বুঝতে পারতো। জ্যোতিষ্কদের পর্যাবৃত্ত গতি তারা বুঝতে পেরেছিল এবং সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের হালকা ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারতো।
নিয়ম মেনে এরপর আসবে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কথা। এই সভ্যতা প্রায় ৩০০০ খপ-তে শুরু হলেও তাদের ঐশ্বর্যের যুগ ব্যাবিলনীয়দেরও পরে। ব্যাবিলন থেকে মিশরীয়রা অনেক কিছু জেনেছে। মানচিত্রে প্রাচীন মিশর দেখা যাচ্ছে, এখানে নীল নদ। এটা বর্তমান সৌদি আরব, এটা বর্তমান তুরস্ক, এটা বর্তমান ইরাক যেখানে সে সময় ব্যাবিলন নগরী ছিল। দেখা যাচ্ছে মিশরের সাথে ব্যাবিলনীয়দের যোগাযোগ ছিল।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন পিরামিড। এই পিরামিডগুলো আবার তাদের জ্যোতির্বিদ্যারও অন্যতম সেরা নিদর্শন। পিরামিড এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে তাদের কোণাগুলো সরাসরি সুমেরুর দিকে থাকে। পৃথিবী যে অক্ষের সাপেক্ষে ঘুরে সেটাকে উত্তর দিকে বাড়িয়ে দিলে তা আকাশের তলকে যে বিন্দুতে ছেদ করে সেটাই সুমেরু। এছাড়া মিশরীয়রা বুঝতে পেরেছিল নীল নদে যখন বার্ষিক প্লাবন হয় কেবল তখনই ভোরের হালকা আলোয় লুব্ধক তারাকে দেখা যায়। এভাবে মিশরীয়রা আকাশের ঘটনার সাথে পার্থিব ঘটনার সম্পর্ক স্থাপন করতো।
অনেক স্থানে আবার আকাশের বস্তুগুলোর গতিবিধি বোঝা এবং তাদেরকে উপাসনা করার জন্য মন্দির বানানো হয়েছিল। সেগুলো ছিল একইসাথে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মানমন্দির এবং প্রধান উপাসনালয়। যেমন ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ যার ধ্বংসস্তূপ এখানে দেখা যাচ্ছে। একই ধরণের আরেকটা মন্দির বানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনাসাজি আদিবাসী সম্প্রদায়, প্রায় ১০০০ বছর আগে। তারা উত্তর গোলার্ধে বছরের দীর্ঘতম দিন যাকে আমরা বলি ২১শে জুন, সেটা উদযাপন করার জন্যই এই মন্দিরটা বানিয়েছিল।
এসব প্রাচীন সভ্যতার অধিবাসীরা কৃষিকাজ ও ধর্মপালনের জন্য অনেক আকাশ চর্চা করলেও তাদের চিন্তাধারা আমাদের বর্তমান বিশ্বচিত্র তৈরিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখেনি। বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাধারার পথে প্রথম এগিয়েছিল প্রাচীন গ্রিকরা। এটা প্রাচীন গ্রিস এবং আয়োনিয়ার মানচিত্র। এটা এজিয়ান সাগর। এজিয়ান সাগরের পশ্চিম উপকূলে প্রাচীন গ্রিক সম্রাজ্যের কেন্দ্র আর পূর্ব উপকূলে গ্রিক উপনিবেশ আয়োনিয়া, বর্তমানে যা আধুনিক তুরস্কের অন্তর্গত। আয়োনিয়াতেই প্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জন্ম হয়েছিল। বলা হয় আয়োনীয় বিজ্ঞান টিকে থাকলে আমরা বর্তমানের তুলনায় আরও অন্তত ১০০০ বছর এগিয়ে থাকতাম।
গ্রিকদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে থেলিসের নাম যাকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক। অনেকে আবার তাকে গণিত ও জ্যামিতির জনকও বলেন। মোটকথা তিনিই প্রথম পৌরাণিক গল্পের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিশুদ্ধ চিন্তা ও গাণিতিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে স্বর্গের কাহিনী বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন তারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি সমুদ্রে জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করার পদ্ধতি বের করেছিলেন।
ওদিকে গণিতকে প্রথমবারের মত একটা বিপ্লবে রূপ দিতে পেরেছিলেন পিথাগোরাস। তবে বিপ্লব বোধহয় একটু বেশিই করে ফেলেছিলেন তিনি। তার গণিত হয়ে গিয়েছিল একটা অন্ধ ধর্ম, আর তিনি হয়ে পড়েছিলেন একজন ধর্মীয় সাধু। পিথাগোরাস বলতেন আকাশের জ্যোতিষ্কগুলো বৃত্তাকার কক্ষপথে চলাচল করে। তবে গণিতে অনেক অবদান থাকলেও পিথাগোরাসের দর্শন ছিল আসলে পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে একটা বাঁধা। কারণ তিনি মনে করতেন পরীক্ষা-নীরিক্ষা বা যাচাই-বাছাই না করে শুধু বিশুদ্ধ চিন্তা বা কল্পনার মাধ্যমেই সব জানা সম্ভব।
পিথাগোরাসের এক শিষ্যের নাম ছিল ফিলোলাউস যাকে এই ছবিতে পিথাগোরাসের সাথে সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করতে দেখা যাচ্ছে। ফিলোলাউস-ই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিদায় করেন। কিন্তু তিনি ভেবে বসেছিলেন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে সূর্য নয় বরং একটা অগ্নিকুণ্ড আছে যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী, সূর্য এবং সব জ্যোতিষ্ক আবর্তন করছে। তিনি মনে করতেন সূর্যের কোন আলো নেই। দেবতা অলিম্পাস মহাবিশ্বের কেন্দ্রে যে আলো জ্বেলে রেখেছেন তা থেকেই সূর্য আলো পায়।
এরপর নাম করতে হয় প্লেটোর। প্লেটো কল্পনাবাদী দর্শনকে একেবারে সরকারী রূপ দিয়ে ফেলেন। তিনি পিথাগোরাসের সরাসরি শিষ্য ছিলেন না, এখান থেকে দেখাই যাচ্ছে পিথাগোরাসের মৃত্যুর অনেক পরে প্লেটোর জন্ম, ৪২৪ খপ-এ। কিন্তু চিন্তা চেতনায় তিনি পিথাগোরাসের খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। তবে এরিস্টটল গুরুর সব কথার সাথে একমত হতে পারেননি, যেটা এই ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন ইতালীয় রেনেসাঁর চিত্রশিল্পী রাফায়েল। ছবিটার নাম দি স্কুল অফ এথেন্স। ছবির একেবারে মধ্যভাগে আছে এখানে প্লেটো আর এখানে এরিস্টটল। মজার ব্যাপার হল প্লেটো আঙুল দিয়ে নির্দেশ করছেন স্বর্গ তথা আকাশের দিকে, আর এরিস্টটল হাত দিয়ে দেখাতে চাইছেন নিচের পৃথিবীকে। পিথাগোরাসের মতোই প্লেটো পৃথিবীকে নোংরা মনে করতেন। তিনি পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও পর্যবেক্ষণের বদলে ঘরে বসে চিন্তা-ভাবনা বা কল্পনা করাকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু এরিস্টটল পর্যবেক্ষণে বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীকে নোংরা মনে না করে বরং তিনি তা পর্যবেক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন পৃথিবী একটা গোলক। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেছিলেন জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে যেতে থাকে তখন তার পালের আগা সবার পরে অদৃশ্য হয়।
পর্যবেক্ষণের উপর কিছুটা আস্থা থাকলেও পিথাগোরাস-প্লেটোর চিন্তাধারার খুব বেশি বিপরীতে এরিস্টটল যেতে পারেননি। তিনি কঠোরভাবে মহাবিশ্বের পৃথিবী-কেন্দ্রিক মডেলকে সমর্থন করেছিলেন। এই সমর্থন আমাদেরকে পিছিয়ে দিয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছর।
কিন্তু থেলিসের উত্তরসূরীরা তখনও টিকে ছিল পৃথিবীতে, তাই পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞানের আরেকটা শিখা জ্বলে উঠেছিল আয়োনিয়া থেকে একটু দূরে, আবারও সেই মিশরে। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মিশর দখল করেন। তখন মিশরের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না, মিশরীয়রা সানন্দেই আলেকজান্ডারকে স্বাগত জানিয়েছিল, দখলটা ছিল রক্তপাতহীন। মিশরের ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলে মিশরের ঠিক এই জায়গাতে একটা শহর তৈরি করেন, শহরটার নাম হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তার মৃত্যুর পর তার সেনাপতি টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় থেকে মিশর শাসন করতে থাকে। টলেমি রাজবংশের শাসনামলে প্রায় ৩০০ বছর আলেকজান্দ্রিয়া গোটা পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী ছিল।
এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম নিয়মতান্ত্রিক গ্রন্থাগার, এবং হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগার। এখানে গ্রন্থাগারের একটা কাল্পনিক ছবি দেখা যাচ্ছে। এখানে আজকের মত বই ছিল না। তখন লেখা হতো প্যাপিরাস পাতায়, প্যাপিরাসের স্ক্রলগুলো গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকতো। অনেকে বলেন প্রায় ১০ লক্ষ প্যাপিরাস স্ক্রল ছিল এই গ্রন্থাগারে যার সবগুলোই আজ হারিয়ে গেছে।
এই গ্রন্থাগারেরই একটা অবিস্মরণীয় বই ছিল, যার লেখক আয়োনিয়ার সামোস দ্বীপের এরিস্টার্কাস। ফিলোলাউসের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেছিলেন, সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আর পৃথিবীসহ সব জ্যোতিষ্ক তাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে। সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সূর্য পৃথিবী থেকে অনেক বড়। আর একটা বড় বস্তু কেন একটা ছোট বস্তুর চারদিকে আবর্তন করবে তা তার মাথায় ঢুকছিল না। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে অন্যান্য তারাগুলো আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে।
এক সময় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন এরাটোস্থেনিস। তিনি গ্রন্থাগারের একটা বইয়ে হঠাৎ পড়েন, মিশরের সায়িন নামক স্থানে বছরের দীর্ঘতম দিনের ঠিক ভরদুপুড়ে কোন বস্তুর ছায়া পড়ে না। তিনি আরও অবাক হলেন এই দেখে যে, সেই দিনের ঠিক একই সময়ে আলেকজান্দ্রিয়াতে ছায়া পড়ে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে এবং আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সায়িনের দূরত্ব পরিমাপের মাধ্যমে তিনি পুরো পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করে ফেলেন, একটা সাপ্লিমেন্ট ভিডিওতে তিনি কাজটা কিভাবে করেছিলেন তা ব্যাখ্যা করা হবে। তিনি পরিধি পেয়েছিলেন ৪০,০০০ কিলোমিটার যা আসল মানের খুবই কাছাকাছি। এছাড়া এরাটোস্থেনিসকে ভূগোলের জনক বলা হয়। তিনি পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি পৃথিবী যে অক্ষের চারদিকে ঘুরে তার নতির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টাও করেছিলেন।
এরপর বলতে হয় আরেকজন আয়োনিয়ান জ্যোতির্বিদের কথা, পের্গা দ্বীপের এপোলোনিয়াস। স্কুলে আমরা যে এপোলোনিয়াসের উপপাদ্য পড়েছি তিনিই তার আবিষ্কারক। তিনি উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত এবং অধিবৃত্তের ধারণা দিয়েছিলেন। এছাড়া টলেমির বিশ্ব-মডেল যে ডিফারেন্ট ও এপিসাইকেলের উপর ভিত্তি করে নির্মীত সেই ডিফারেন্ট ও এপিসাইকেলের প্রবক্তাও তিনি। এই ছবিতে ব্যাপারটা বোঝানো হয়েছে। আরেকটা সাপ্লিমেন্টে এটা ব্যাখ্যা করা হবে।
আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার কেবল গ্রন্থাগারই ছিল না, এখানে স্থাপিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক গবেষণাগার। এখানে কাজ করতেন হিপ্পার্কাস যাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষক বলা হয়। তিনিই প্রাচীন যুগের সেরা জ্যোতির্বিদ। আকাশের তারাগুলোকে আপাত উজ্জ্বলতার উপর ভিত্তি করে তিনি বিভিন্ন মান দেন। ত্রিকোণমিতির উন্নতি সাধন করেন, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব-নিকাশে ত্রিকোণমিতিক ছক ব্যবহার করেন। সূর্যগ্রহণের প্রথম নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ইউরোপের প্রথম পরিপূর্ণ তারা তালিকা প্রণয়ন করেন। এছাড়া তিনি পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের অগ্রগমন আবিষ্কার করেছিলেন। এই লাল রেখাটাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী এই দিকে ঘুরে। আবার এই লাল রেখাটাও এই বৃত্তের পথ ধরে ঘুরে। এই বৃত্তের পরিধি পুরোটা ঘুরে আসতে এই রেখার প্রায় ২৬ হাজার বছর সময় লাগে। এতো সূক্ষ্ণ একটা বিষয়ও হিপ্পার্কাসের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
হিপ্পার্কাসের পর প্রাচীন গ্রিস ও আলেকজান্দ্রিয়ার জ্যোতির্বিদ্যা আর সামনের দিকে এগোয়নি। উল্টো ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রন্থাগারটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সে বছর রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়ার দখল নেয়ার জন্য শহর জ্বালিয়ে দেন যে আগুনে গ্রন্থাগারটিও পুড়ে যায়। অবশ্য এরপরে আগুনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া বইগুলো নিয়ে আরেকটা ছোট গ্রন্থাগার বানানো হয়েছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা তখনও কিছুটা অবশিষ্ট ছিল যার প্রমাণ টলেমি, তার জন্ম যিশু খিস্টের জন্মের ৯০ বছর পর। এই টলেমির সাথে টলেমি রাজপরিবারের অবশ্য কোন সম্পর্ক নেই। টলেমি একটা বিখ্যাত বই লিখেন, যা জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি, নাম আলমাজেস্ট। এই বইয়ে এরিস্টার্কাসের বদলে এরিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মতবাদ পূর্ণতা পায়। টলেমির কারণে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র- এটা অনেকটা ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়। তিনি মহাবিশ্বের একটা বিস্তৃত ভূকেন্দ্রিক মডেল তৈরি করেন। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব তিনি বলেছিলেন পৃথিবীর ব্যাসের ১২১০ গুণ, আর তারাদের দূরত্ব ২০ হাজার গুণ। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মূল ভিত্তিও তার হাতে তৈরি। আকাশের জ্যোতিষ্ক যে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে সেটাও টলেমি ধ্রুব সত্য বানিয়ে দেন।
তার ভূকেন্দ্রিক মডেলের একটা ছবি এখানে দেখানো হয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা প্লেটো, এরিস্টটল এবং টলেমির মতবাদ পুরোপুরি গ্রহন করে। এই তিনজন পরিণত হন খ্রিস্টান চার্চ শাসিত পশ্চিমা বিশ্বের তিন পথ প্রদর্শকে। কিন্তু এতে করে বিজ্ঞান পিছিয়ে যায় ১৫০০ বছর। তখন ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে।
অনেকে হাইপেশিয়ার মৃত্যুর সময়কে ইউরোপে অন্ধকার যুগের সূচনা হিসেবে দেখেন। হাইপেশিয়া জ্যোতির্বিদ্যায় কোন মৌলিক অবদান না রাখলেও পূর্ববর্তী অনেক কিছু চর্চা করেন এবং আরও সূক্ষ্ণ তারা তালিকা তৈরিতে অবদান রাখেন। তিনি পেগান তথা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাতেই তিনি গবেষণা করতেন ও শিক্ষা দিতেন। কিন্তু এই শহরে দিনদিন খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপের আদেশে একটি খ্রিস্টান জঙ্গি বাহিনী ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে হাইপেশিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শুরু হয় ইউরোপের অন্ধকার যুগ।
হাজার বছরেরও বেশি সময় পর থেলিস, এরিস্টার্কাস, এরাটোস্থেনিস এবং সার্বিকভাবে আয়োনিয়ার বিজ্ঞানের ধারা আবার ফিরে আসে। ফিরিয়ে আনেন কোপার্নিকাস, গালিলেও, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, ক্রিস্টিয়ান হাওখেন্স, কেপলার এবং টাইকো ব্রাহেদের মত বিজ্ঞানীরা।
========================

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন